ঃ এম আর মাহমুদ ঃ
ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানী (বিএটি) চাষিদের নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়ে আজ থেকে ৩ যুগ পূর্বে কক্সবাজারের চকরিয়া, রামু, কক্সবাজার সদরের কিছু অংশ ও বান্দরবানের ৭ উপজেলায় তামাক চাষ শুরু করে।
প্রথমদিকে চাষিরা কোম্পানীর সাহায্য-সহযোগিতায় তামাক চাষ শুরু করলেও বর্তমানে তামাক কোম্পানীর লোকজন কৌশলগত প্রতারণার মাধ্যমে চাষিদের অতিষ্ট করে তুলেছে। কিন্তু চাষিরা ইচ্ছা থাকলেও ওইসব কোম্পানীর তামাক চাষ ছাড়তে পারছে না।
বেশিরভাগ তামাক চাষিদের অভিমত, তামাক চাষ চাষিদের জন্য আশীর্বাদ নয়, যেন অভিশাপ। এসব কোম্পানী রক্তচোষা বর্গির দল। একজন তামাক চাষি অন্তত ৬মাস কায়িক পরিশ্রম করে উৎপাদিত তামাক স্বাধীনভাবে বাজারে বিক্রি করতে পারেনা। ফলে বাধ্য হয়ে চাষিরা তামাক কোম্পানীর ইচ্ছামত মূল্যে তামাক বিক্রি করছে।
তামাক চাষ শুরু হওয়ার পর থেকে তামাক চুল্লিতে পোড়ানো হয়েছে লাখ লাখ টন বিভিন্ন প্রজাতির কাঠ। ফলে কক্সবাজার ও বান্দরবানের বেশিরভাগ পাহাড় বৃক্ষশূন্য ন্যাড়া পাহাড়ে পরিণত হয়েছে। যে ক্ষতি পোষানো কোনদিনই সম্ভব নয়। বিএটি প্রতিবছর যে পরিমাণ রাজস্ব সরকারি কোষাগারে দিচ্ছে হিসাব করলে রাষ্ট্রের ক্ষতির পরিমাণ তিনগুণ বেশি হবে।
ওই কোস্পানী বিশাল অংকের রাজস্ব প্রতিবছর সরকারি কোষাগারে জমা দিচ্ছে। চাষিদের উৎপাদিত তামাক থেকে বিভিন্ন ব্রান্ডের সিগারেট তৈরি করে বাজারে বিক্রিপূর্বক এসব তামাক কোম্পানী হাজার হাজার কোটি টাকা আয় করলেও বিপণœ চাষিদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয়নি।
প্রথমদিকে বিএটি’র সড়ক বনায়ন, নার্সারী থেকে বৃক্ষ চারা বিতরণ ও স্বাস্থ্যসেবার নামে হেল্থ কার্ডসহ কত লোক দেখানো আশ্বাসের বাণী শুনিয়েছে। কিন্তু তাদের আসল চরিত্র ভুলে গেলে চলবে না। এ ব্রিটিশরা ব্যবসার নাম দিয়ে ২০০ বছর রাজত্ব করেছে এখানে। আমাদের স্বাধীনতা বিপণœ করেছে।
একসময় নীল চাষের মাধ্যমে এ দেশের কৃষকদের মেরুদন্ড ভেঙ্গে দিয়েছে। তাদের নির্যাতনে অতিষ্ট ছিল কৃষককূল আন্দোলন করতে বাধ্য হয়েছিল। সে নীল চাষের কুটিরগুলো এখনও বিদ্যমান আছে। নীল চাষ বিদায় হলেও তামাক চাষ বিদায় হয়নি।
বিএটির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বেশিরভাগই এদেশীয় এবং সর্বোচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত যুবক। তারা চাষিদের অধিক লাভের আশ্বাসের বাণী শুনিয়ে তামাক চাষে জড়াচ্ছে এবং পথেও বসাচ্ছে! গ্রামের একটি প্রবাদ না বললে হয় না “এক সময় কুঁড়ালের কাছে কাঠ জানতে চাইল, আমার কি অপরাধ? শুধু শুধু আমাকে কাটছ কেন? তখন কুঁড়াল জবাব দিয়েছিল- ভাই আমার কোন দোষ নেই। আমার পিছনে যে ছিদ্র আছে সেই ছিদ্রেও কাঠের হাতল না ঢুকালে আমার পক্ষে কাঠ কাটা কোনদিন সম্ভব নয়।”
অনুরূপভাবে এ দেশের শিক্ষিত যুবকেরা যারা ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোতে উচ্চ বেতনে চাকরী করছে, আর আলিশান গাড়ি হাঁকাচ্ছে, তারাই এ দেশের কৃষকদের সর্বশান্ত করছে। ব্রিটিশ আমেরিকা টোব্যাকো কোম্পানীতে নিয়োজিত এ দেশীয় কর্মকর্তারাই স্বদেশী চাষিদের মুখের গ্রাস কেড়ে খাচ্ছে।
অথচ বর্তমানে বিএটি, ঢাকা টোব্যাকো ও আবুল খায়ের টোব্যাকোর তামাক আগ্রাসন থেকে রক্ষার জন্য উপজেলা প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি এবং এনজিও’র উদ্যোগে বেশ ক’বছর ছাত্র-ছাত্রীদের রাস্তায় দাঁড় করিয়ে মানববন্ধন করেছে। কিন্তু তামাক চাষ ঠেকাতে পারেনি। অথচ রাস্তায় দাঁড়িয়ে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা তামাক চাষ বন্ধের জন্য গায়ের ঘাম ফেলেছে। আর তামাক চাষ যারা করে তারা প্রতারিত হয়ে নিঃস্ব হয়েছে।
তাদের কথা ভুলে গিয়ে আমার আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সারাদিন রোজা রেখে বিএটি’র ইফতার পার্টিতে যোগ দিয়ে ভুরিভোজন করার যৌক্তিকতা খুঁজে পাই না। আর বিএটি’র ইফতার পার্টির আয়োজন করা হয় তাদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে। সে কারণে সরকারি কর্মকর্তা, রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতা, সুশীল সমাজের কিছু প্রতিনিধি ও খ্যাত-অখ্যাত সাংবাদিকদের ইফতার করাচ্ছে। অথচ এ ইফতার পার্টিতে ক’জন তামাক চাষিকে ইফতারের সুযোগ দেয়া হয়।
আমি প্রতিবাদের ভাষায় বলব, সরকারি ভর্তুকির সার তারা তামাক চাষে ব্যবহার করাচ্ছে। সরকারি ও বেসরকারি বন ধ্বংস করছে। উর্বর জমিগুলোতে ধান-সবজির পরিবর্তে পরিবেশ বিধ্বংসী তামাক চাষ করাচ্ছে। যে কারণে মানুষ নানা দূরারোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এত ক্ষতির পরও সরকারি কর্মকর্তা, রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী, সুশীল সমাজ ও সাংবাদিকরা বিএটি’র ইফতার পার্টিতে যোগ দেয়াটা জাতির সাথে চরম বিশ্বাস ঘাতকতা নয় কি?
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘কুলি-মজুর’ কবিতার দু’টি চরণ উল্লেখ করে লেখাটি শেষ করতে চাই ‘দেখিনু সেদিন রেলে কুলি বলে, এক বাবু সাব ঠেলে দিল নিচে ফেলে। চোখ ফেটে এলো জল, এমনি করিয়া জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল।’
এম আর মাহমুদ
সভাপতি-চকরিয়া অনলাইন প্রেস ক্লাব।
পাঠকের মতামত: